সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী সম্পর্কে আলোচনা কর - Online story

Monday 9 September 2024

সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ বাহিনী সম্পর্কে আলোচনা কর

 

সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম সম্পর্কে লেখো।
উত্তর- সুভাসচন্দ্র বসু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন আদর্শের সমন্বয়ে। তিনি একদিকে বিংশ শতকের জার্মান জাতীয়তাবাদী শরিক হতে চেয়েছিলেন। তেমনি সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনৈতিক সাম্যের কিছুটা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রা। তার সঙ্গে। স্বামী বিবেকানন্দের সাংগঠনিক ভাবনা চিন্তাও সুভাষচন্দ্রকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
সুভাষচন্দ্র যখন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলেন তখন গান্ধিজি অনেক আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। সুভাষ অহিংস পন্থায় পুরোপুরি বিশ্বাসী না হলেও গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নেন। ধীরে ধীরে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সংস্পর্শে আসেন। তিনি সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে বাংলা কংগ্রেসের প্রচার বিভাগের সম্পাদক ও জাতীয় কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের কলিকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে স্বরাজ দল জিতে যায়।
চিত্তরঞ্জন কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন, সুভাষচন্দ্র প্রধান কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পান। এই সময়ে কর্পোরেশনের উদ্যোগে বহু উন্নয়নমূলক কাজ হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়। তখন থেকেই সুভাষচন্দ্র নিজের উদ্যোগে পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে বস্তুবা প্রচার করেন। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা অধিবেশনে গান্ধিজির সঙ্গে সুভাষের সংঘাত শুরু হয়।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য শুরু হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়েন, চিকিৎসার জন্য তাঁকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান বেনিতো মুসোলিনির সাথে সুভাষের সাক্ষাৎ হয়। ১৯৩৩ সালে আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেওয়া হলে সুভাষ কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেন।
১৯৩০ এর দশকে কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো রক্ষণশীল নেতৃত্বে
কান্দোলনের উপায় ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখা যাচ্ছিল। সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল প্রমুখ তরুণ নেতারা বিভিন্ন ধরনের বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণের পক্ষপাতি ছিল। সব মিলিয়ে কংগ্রেসের ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেই বড়ো রকমের ফাটল দেখা যায়।
এই ঘটনার ফলে কংগ্রেসের উচ্চ নেতৃত্বে রক্ষণশীলদের প্রভাব বাড়লে সাধারণ মানুষ কংগ্রেস সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। দলের সদস্য সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। চূড়ান্ত অসন্তোষ দেশজোড়া গণঅভ্যুত্থানের পথ তৈরি করেছিল।
১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন তারই প্রমাণ। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সুভাষের বিশ্বাস ছিল জার্মানির হাতে ব্রিটিশের পরাজয় হবেই। তাই সবদিক দিয়ে ইংরেজদের উপর সুভাষ চাপ বাড়াবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী বসু যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করেন, মোহন সিংহ ছিলেন তার সহযোগী ক্যাপ্টেন। রাসবিহারী  বসুর অনুরোধে সুভাষ চন্দ্র জাপানে গিয়ে আজাদ-হিন্দ-ফৌজের দায়িত্ব ভার নেন। ১৯৪৩ এর ২৩শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বা স্বাধীন ভারতের যুদ্ধকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। তিনি হন তার প্রধানমন্ত্রী এবং বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। নভেম্বর মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে জাপান অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দেন। ১৯৪৪ এর ৪ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রথম ব্যাটেলিয়ান রেঙ্গুন থেকে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে। ১৯৪৪ এর ১৯ মার্চ তাঁরা ভারতের মাটিতে জাতীয় পতাকা উত্তেলন করেন। ধীরে ধীরে
আজাদ হিন্দ বাহিনী সাফল্যের মুখ দেখতে পায়। কিন্তু বর্ষা ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও জাপানের কোণঠাসা অবস্থা আজাদ বাহিনীকে সংকটে ফেলে দেয়। খাদ্যের অভাব, রোগ, শীত ও ম্যালেরিয়ার জন্য, প্রচুর সৈনিক মারা যান। এছাড়া নানা
সমস্যা ও বাধায় পড়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান সফল হয়নি। তবু সুভাষচন্দ্র আশা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্যের আশা তাঁর ছিল। জাপান সরকার সুভাষকে রাশিয়া চলে যাওয়ার জন্য মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু যাত্রাপথে তাইওয়ানে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। বলা হয়, ওই দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসু মারা গেছেন—কিন্তু খবরটি নিয়ে সকালের মধ্যে সংশয় ছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান শেষ হলেও ভারতের রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়েছিল।
আত্মসমর্পন করার পর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানায়কদের লালকেল্লায় বিচার শুরু হলে দেশব্যাপী প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। পি. কে. সেহগাল, জি. এ. ধিলো ও শাহনওয়াজ খান এই তিন জনকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এর প্রভাব পড়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর। ১৯৪৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বা ব্রিটিশ সরকারের নৌবাহিনী প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ শক্তি বুঝতে পারছিল ভারতে তাদের শেষের দিন ক্রমশই এগিয়ে আসছে।


প্রশ্ন:-ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব আলোচনা করো।
উঃ। এশিয়া ও ইউরোপের ছোটো বড়ো নানা দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ঔপনিবেশিক হওয়ার ফলে ভারতের অর্থনীতিও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়ে নরমপন্থীরা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বহু ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ হারান। ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় প্রবলভাবে বেড়ে গিয়েছিল। যার ফলে জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বাড়তে থাকে। সেই সময় বাদ্যশস্য উৎপাদনও কমে যায়। ১৯১৮-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বুকে নেমে আসে হাহাকার, দুর্ভিক্ষ। অকাল দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক ব্যাধির কারণে বলি হয় কয়েক লক্ষ মানুষ। ক্রমে ভারতে শ্রমিকরা সংগঠিত হতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয়দের মোহভঙ্গ হয়।

প্রশ্ন:-মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার কী ছিল?
উঃ। প্রধন বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয়দের দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশ সরকার বাস্তবায়িত করেনি। এই অবস্থায় ভারতে স্বশাসন বা Home Rule Movement জোরদার হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-সচিব মন্টেগু এবং লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন পাশ করেন। এই আইনে বিভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। যদিও এই সংস্কারগুলি ভারতীয়দের পছন্দ হয়নি। কারণ ভারতীয়দের স্বশাসনের
দাবিকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে মানা হয়নি।
• গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনা কীরূপ ছিল?
উঃ। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দ স্বরাজ' নামের রচনায় গান্ধিজি তাঁর স্বরাজ বিষয়ে সামাজিক দাবিগুলিকে ও আদর্শগুলিকে স্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল শুধু ঔপনিবেশিক শাসন বা ব্রিটিশরা নয় সমগ্র পাশ্চাত্য আদর্শভিত্তিক আধুনিক শিল্প সমাজই ভারতের সাধারণ মানুষের শত্রু। স্বরাজ হলো রাজনৈতিক ভাবে অর্ধেক স্বাধীনতার দাবি। শুধু ব্রিটিশ  শক্তিকে তাড়ালেই হবে না, তাদের চিন্তা ভাবনা, আদর্শ সবকিছুকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে। সবাইকে চাষিদের মতো সহজ সরল জীবন-যাপন করতে হবে।