ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ বিশ্লেষণ কর
প্রশ্ল- ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ বিশ্লেষণ করো। অথবা, উনিশ শতকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের কারণগুলি আলোচনা করো।
উত্তর:-
ভূমিকা : ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে ভারতে কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। বিদেশি শাসনের অনিবার্য।
ফলশ্রুতি হিসেবেই আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।
ভারতের জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রেক্ষাপট।
★ইউরোপীয় প্রেক্ষাপট
(১) আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ
(২) ফরাসি বিপ্লব
(৩) জাপানের সাফল্য ও অগ্রগতি
(৪) ইতালির ঐক্য আন্দোলন
(৫) রাশিয়ায় নিহিলিস্ট আন্দোলন
°★ভারতীয় প্রেক্ষাপট
(১) ব্রিটিশ অনুশাসন
(২) পাশ্চাত্য শিক্ষা
৩) অর্থনৈতিক শোষণ
(৪) জাতিবৈরিতা
(৫) সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব
(৬) ধর্ম ও সমাজ সংস্কার
(৭) সংবাদপত্র ও সাহিত্য
(৮) রাজনৈতিক সমিতি
★ ইউরোপীয় প্রভাব : সমগ্র উনিশ শতক ইউরোপ ও বহির্বিশ্বের নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলি ভারতবাসীদের মনে জাতীয়তাবোধের
সঞ্চার ঘটিয়েছিল। যেমন—(১) আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৪ খ্রি.), (২) ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) এবং
(৩) জাপানের সাফল্য ও অগ্রগতি,
(৪) ইতালির ঐক্য আন্দোলন,
(৫) রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন প্রভৃতি।
ভারতীয় প্রেক্ষাপট : ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর (১৭৬৫ খ্রি.) থেকেই নানা ঘটনাবলির প্রভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়, যেমন—
১..ব্রিটিশ অপশাসন : ব্রিটিশ অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মনে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকেই জাতীয় চেতনা সঞ্চিত হতে থাকে, এরই পরিণতি জাতীয়তাবাদের বিকাশ।
২. পাশ্চাত্য শিক্ষা : পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বহির্বিশ্বের নানা ঘটনাবলির দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব জাগ্রত হতে থাকে।
৩.অর্থনৈতিক শোষণ : ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে ভারতের অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও ব্রিটিশ শাসক ভারতের অর্থনৈতিক সংকট মোচনের কোনো সুব্যবস্থা গ্রহণ না-করায় ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে।
৪ জাতিবৈরিতা : ব্রিটিশ শাসকেরা জাতিগত দিক থেকে ভারতীয়দের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করত। শাসনব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে উভয়ের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বাড়তে থাকে। ইলবার্ট বিল বিতর্ক ছিল এর জ্বলন্ত উদাহরণ, ‘যা শিক্ষিত ভারতীয়দের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।'
[৫] সিপাহি বিদ্রোহের প্রভাব : সিপাহি বিদ্রোহের পর মহারানির তরফে যে প্রতিশ্রুতিগুলি ভারতীয়দের দেওয়া হয়েছিল তা পালন করা না হলে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের ঘৃণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৬. ধর্ম ও সমাজ সংস্কার : সমগ্র উনিশ শতকজুড়ে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ধারা প্রবাহিত হয়। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত সংস্কার আন্দোলন সামাজিক কুসংস্কার ও গলদ সাফাই করতে সচেষ্ট হয়। বাংলায় ব্রাত্মসমাজ আন্দোলন, মহারাষ্ট্রে প্রার্থনাসমাজ ও উত্তর ভারতে আর্যসমাজ আন্দোল প্রসার,
জাতিভেদ নিবারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। দেশবাসীর জড়তা ও স্থবিরতা বেশ কিছুটা কমে যায়।।
৭. |সংবাদপত্র ও সাহিত্যের ভূমিকা : ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহিত্য ও নাটকের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। দীনবন্ধু
মিত্রের 'নীলদর্পণ', দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'সূর্যের দেশ', শাহজাহানের মেবার পতন' ছাড়াও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসুদন দত্ত,শাস্ত্রী-রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (পদ্মিনী উপাখ্যান) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায়
জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
৮.সভাসমিতি : বাংলায় জাতীয়তাবোধের উন্মেষে ঊনবিংশশতকে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক সভাসমিতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল করে।ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, যা স্বাধীনতা পর্যন্ত ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করেছিল।
>> মূল্যায়ন: এইভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন ঘটনা ও ভাবধারার প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে।